বৃহস্পতিবার , মে ২ ২০২৪

আমাদের ঈদ উৎসব ও সংস্কৃতি

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

ঈদ অর্থ আনন্দ, আর উৎসব বলতে সাধারণত সামাজিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যগত প্রেক্ষাপটে পালিত আনন্দ অনুষ্ঠানকে বুঝায়। ঈদ উৎসব – ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ এবং ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ প্রধানত ধর্মীয় উৎসব। তবে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর ব্যাপক ও বিরাট প্রভাব রয়েছে।

কেননা, ইসলাম ধর্ম একটি আন্তর্জাতিক ধর্ম হওয়ায় এবং প্রায় একই সময় সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপিত হওয়ায় এই ঈদের আনন্দ বলা যায় গোটা বিশ্বকেই স্পর্শ করে। বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের ইতিহাস এদেশে মুসলমানদের আগমন ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলা যায় হাজার বছর আগ থেকেই এই দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বি সর্বস্তরের মানুষ স্বস্ফূর্তভাবে ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহ্যিক চেতনায় ঈদ উদযাপন করে আসছে। তাই বলা যায়, আমাদের এই স্বাধীন বাংলায় ঈদ উদযাপনের একটি ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতাও রয়েছে।

তবে ঈদ কোন বল্গাহীন আনন্দ-উৎসবের নাম নয় বা এটি গতানুগতিক কোন উৎসব নয়। যেহেতু এগুলো ধর্মীয় উৎসব, তাই এর সাথে আধ্যাত্মিক ভাব-গাম্ভির্যের বিষয় জড়িত।

সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিরূপ যা তার আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি হল মার্জিত জীবনাচার। তবে একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কতটা শিষ্ট ও মার্জিত হবে তা নির্ভর করে তার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ঋদ্ধতার উপর। কেননা, মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভাবনা বা ভাল-মন্দের বোধ। মানুষের জীবনবোধের বিন্যাসে এবং একটি জাতির মানস গঠনে ধর্মেরও একটি বিরাট ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কেননা, ধর্ম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটি বিশিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস প্রদান করে। কাজেই ঈদ উৎসবে ধর্মীয় আদর্শের একটি প্রভাব থাকা স্বাভাবিক এবং যারা ইসলামের ধর্মীয় আদর্শকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তাদের উচিত বল্গাহীন উল্লাসে গা ভাসিয়ে না দিয়ে ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্যকে স্মরণে রাখা এবং তাকে অনুসরণ করা।

ঈদুল ফিতর

ঈদুল ফিতরের প্রচলন কীভাবে হলো এ বিষয়ে নানান জনে নানান মত প্রকাশ করলেও পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ইসলাম ধর্মের যাবতীয় বিধি-বিধান এবং জ্ঞানের মূল উৎস হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। নামাজ, রোজা, হজ¦, যাকাত ইত্যাদি বিধানের মত এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য দুটি প্রধান উৎসব পালনের নির্দেশদাতাও হলেন আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর যে ঈদ আমরা পালন করি তার সুস্পষ্ট নির্দেশদাতা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। যেমন:

‘হে লোক সকল, তোমাদের কাছে তোমাদের আল্লাহ’র কাছ থেকে নসিহত (কোরআন) এসে পৌঁছেছে; এতে রয়েছে অন্তরের রোগের পূর্ণ নিরাময়; আর যে তা কবুল করবে তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে পথনির্দেশ এবং রহমত। (হে নবী) বল: এটা আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এই প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-উৎসব করা উচিত। এটা সেসব থেকে উত্তম, যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করে থাকে।- [সূরাহ ইউনুস: আয়াত ৫৮]

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র রমজান মাসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেন। আল কোরআন হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র ঐশীগ্রন্থ যা তার অকৃত্রিম, অবিকৃত ও আসল রূপে বিদ্যমান। মানব জাতির জন্য এটি এক বিরাট ঘটনা এবং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। কারণ, এই ঐশীগ্রন্থের কল্যাণেই আমরা ¯্রষ্টার সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ পেয়েছি। তাই এই মহাগ্রন্থের অবতীর্ণ উপলক্ষেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নির্দেশে মহানবী (সা.) মুসলমানদের জন্য দুটি উৎসব পালনের ঘোষণা দেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক জাতিরই উৎসব রয়েছে, আমাদের উৎসব হলো ঈদ।’’

ঈদুল ফিতরকে বলা হয় রোজা ভাঙ্গার দিন। এদিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ বরং রোজা ভাঙ্গা বাধ্যতামূলক। দীর্ঘ এক মাস আমরা আমাদের পরম প্রভুর নির্দেশে দিনের বেলা সকল ধরনের পানাহার সহ অন্যসব নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছি। আবার তাঁরই নির্দেশে রোজা ভাঙছি। দীর্ঘ এই এক মাস দিনের বেলা পানাহার বন্ধ রেখে এদিন রোজা ভাঙ্গার আনন্দই ঈদুল ফিতর। ফিতর অর্থ ভাঙ্গা। ঈদুল ফিতর অর্থ তাই রোজা ভাঙার আনন্দ। তবে এই আনন্দ তারাই উপলব্ধি করে থাকেন যারা পুরো রমজান মাস জুড়ে রোজা রাখেন। যারা সারা মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের চেষ্টা করেছেন তাদের নিকট বরং ঈদ হলো পাপমুক্তির আনন্দ। সফলতা ও বিজয়ের আনন্দ। এ বিজয় নাফসের ওপর আকলের, এ বিজয় শয়তানের ওপর ইনসানের।

ঈদুল ফিতরের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো ফিতরা আদায় করা। এটি প্রদান করা প্রত্যেক স্বচ্ছল মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিৎরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিৎরা আদায় করা যায়। ফিৎরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামী বিধান অণুযায়ী নির্দ্দিষ্ট। সাধারণত ফিৎরা নির্র্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা অন্য শস্যের (যেমন: যব, কিসমিস) মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিৎরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। পরিবারের সবার পক্ষ থেকে পরিবার প্রধান এটি আদায় করে থাকেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন রোজা শুদ্ধ হয়, অন্যদিকে সমাজের গরীব অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়। রোজার মাসে অনাহারে থেকে আমরা অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের দূঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি এবং তাদের প্রতি সহানুভূতির শিক্ষাই লাভ করেছি। ঈদের আগে রমজান মাসে যাকাতও আদায় করতে হয়। এই পবিত্র মাসে দান-খয়রাত করলে অন্য সময়ের তুলনায় ৭০ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। ফলে দেখা যায় সাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠার আগেই যাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ইত্যাদির উসিলায় ধনীর পকেটের কিছু টাকা গরীবের হাতে যায়। এর ফলে গরীবের মুখেও কিছুটা হাসি ফোটে এবং ঈদ অনেকটা সার্বজনীন হয়ে ওঠে। যদি এসব ব্যবস্থা না থাকতো তাহলে ঈদের আনন্দ শুধু ধনীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো আর গরীবরা থাকতো বঞ্চিত।

আসলে ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উৎবের সাথে সিয়াম সাধনার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি আমাদের প্রধান ঈদ উৎসব ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় শিক্ষা ও তাৎপর্যের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব, একটি সুস্থ ও কল্যাণমুখি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তা বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও কোরআন তিলাওয়াত-অধ্যয়ন ও ইবাদত-উপাসনার রোজাদার স্রষ্টার নৈকট্য অনুভব করেন। এর ফলে তাদের মন আগের তুলনায় অনেক নরম হয়, আত্মশুদ্ধির জন্য এই জিনিসটির কোন বিকল্প নেই। আমরা অনেকেই সমাজ বদলের কথা বলি, দিন বদলের কথা বলি। কিন্তু দিন বদলের জন্য সবার আগে যে দিল বদলের প্রয়োজন সে কথাটি ভুলে যাই। মাহে রমজান কিন্তু এই দিল বদলের শিক্ষা ও সুযোগ নিয়েই আমাদের মাঝে হাজির হয়।

তাই দেখা যায়, এই সময় মুসলমানরা আপনাকে নিয়ে বিভোর থাকার পরিবর্তে গরীব আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নেন, নিজের পরিবারের পাশাপাশি তাদের জন্য কেনাকাটা করেন, সারা বছর খোঁজ না নিলেও ঈদের সময় মা-বাবা, ভাই-বোন সহ আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়ীতে ছুটে যান। সকল মান-অভিমান, ঝগড়া বিবাদের কথা ভুলে ঈদের নামাজের পর একে অন্যকে আলিঙ্গন করেন, কোলাকুলি করেন।