॥ কাশেম ছিদিকী ॥
বুয়েটে আবরার হত্যার ঘটনায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ভিসি মহোদ্বয়। গত সপ্তাহে ছাত্রদের সাথে এক সমজোতা সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। প্রশ্ন হলো, সকলকে নিষিদ্ধ কেন? অন্যায় তো সবাই করেনি। অন্যায় করেছে ছাত্রলীগ।
শুধু বুয়েটের আবরারকেই নয়, গত ১০ বছরে ঢাবি, বুয়েট, রাবি, চবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তাদের হাতে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী।
এই ২৪ জনের মধ্যে চবি’তে ৮ জন, রাবি’তে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাকৃবি’ত ২ জন, জবি’তে ২ জন, ঢাবি’তে ১জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৩ টি হত্যাকান্ড।
এসব হত্যাকান্ডের ১৭টিই ঘটেছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতার দাপট, আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, ও টেন্ডারবাজি-ই ছাত্রলীগকে দিয়েছে এমন ভয়াবহ দানবীয় রূপ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েঃ-
১) ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির রাতে চট্টগ্রামের ষোল শহর রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন কায়সারকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ।
২) ছাত্রলীগ একই বছরের ১২ জানুয়ারী শাহ আমানত হল ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেনকে অত্যন্ত পাশবিক কায়দায় হত্যা করে।
৩) রাতের শাটল ট্রেনে চট্টগ্রাম শহর হতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে ছাত্রলীগ চবি মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশীদকে গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে এই বছরেরই ২৮ মার্চ মাসে।
৪) আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাত্রলীগ কর্মী তাপস।
৫) ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চবির ২নং গেট সংলগ্ন নিজ বাসায় নিজ কর্মীদের হাতে খুন হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা দিয়াজ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ঃ-
৬) রাবি’র শিবির সেক্রেটারী শরিফুজ্জামান নোমানীকে ছাত্রলীগ অত্যান্ত পাশবিক কায়দায় খুন করে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ মাসে।
৭) ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট শোক দিবসের টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলার ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিরুল্লাহ নাসিমকে ফেলে হত্যা করে ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা।
নিষিদ্ধটা হলোনা শুদ্ধ
৮) পদ্মা সেতুর চাঁদা ভাগাভাগি নিয়ে ক্যাম্পাসে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ২০১২ সালের ১৫ জুলাই মাসে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল।
৯) ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১৪ সালে বলি হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ।
ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েঃ-
১০) নিজেদের অভ্যান্তরীন কোন্দলের গুলিতে ১০ বছরের শিশু রাব্বিকে হত্যা করে মা’য়ের বুক খালি করে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের হত্যার রাজনীতির খুব সামান্যই তুলেধরা সম্ভব হলো। নানা ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সংগঠনটি আজ ধারন করেছে এক ভায়াবহ দানবীয় রূপ। তারা হেসে-খেলেই করে যাচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য এমন অপরাধ।
অথচ একটি সংগঠনের রুটিন অপরাধের দায়ে বুয়েটে নিষিদ্ধ করা হলো সব ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি। এ সিদ্ধান্ত নির্দোষ সংগঠনগুলোর উপর জুলুমও বটে ;
তাছাড়া দেশ ও জাতি গঠন এবং যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশে ছাত্ররাজনীতির অপরিহার্যতা অস্বীকার করার সুযোগ নাই।
আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই ছাত্র রাজনীতিরই এক সেরা উপহার। ছাত্র রাজনীতিই যোগ্য করে গড়ে দিয়েছিল অধ্যাপক গোলাম আযমের মত উচু মাত্রার ভাষা সৈনিক। নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলীর মত দেশপ্রেমিক, চৌকষ ও আদর্শ রাজনীতিক পেয়েছিলাম ছাত্ররাজনীতির কারখানা থেকেই।
ছাত্র রাজনীতি-ই তোফায়েল, মতিয়া, মেনন, সেলিম, রব ও মান্নার মত দূর্দন্ড প্রতাপশালী বাঘা বাঘা রাজনীতিক উপহার দিয়ছিল আমাদের।
সেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে কিভাবে তৈরী হবে জাতির আগামী নেতৃত্ব?
ছাত্ররাই তো রচনা করেছিল ৪৭’র দেশ বিভাজন, ৫২’র ভাষা আন্দলন ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৯০’র শৈরাচার পতন আন্দোলন। শুধু তাই নয়, একাত্তরে ছাত্ররাই তো বিশ্ব মানচিত্রে একে দিয়েছিল বাংলাদেশ নামের একটি ভূখন্ড।
সেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পচনধরা অঙ্গ দেহ থেকে অপসারন না করে গোটা দেহটাকে ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করার মতই এ সিদ্ধান্ত।
এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে বুয়েটকে। শুধু বুয়েটে নয়; অপরাধীদের নিষিদ্ধ করতে হবে সারা দেশের বাকীসব শিক্ষা প্রতষ্ঠানে। অপরাধীদের নিষিদ্ধ করেই বাঁচাতে হবে পচনধরা ছাত্ররাজনীতি।
নিষিদ্ধটা হলোনা শুদ্ধ তাহলেই বিকশিত হবে সৎ যোগ্য নেতৃত্ব, রক্ষিত হবে দেশ, রক্ষা পাবে মানচিত্র।