কাশেম ছিদ্দিকী
দেশে চলছে এক ভয়াবহ বন্যা। দেশটির উত্তর ও মধ্যাঞ্চল ভাসছে বানের পানিতে। বিশেষ করে চরাঞ্চলগুলোতে ব্যাপক আকার ধারন করেছে এর ভয়াবহতা। ইতিমধ্যে পানিবন্দি হয়েছে ২১টি জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। এদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে বেড়ি বাঁধ, রেল লাইন, স্কুল- কলেজ, আশ্রয় কেন্দ্র, উঁচু কোন সংকীর্ণ জায়াগা, ঘরের চালে বা গাছের ডালে।
ইতিমধ্যে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই। সরকারি হিসাবেই গত তিন সপ্তাহে বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে মারা গেছে ৮৬ জন বনি আদম। আর ৬ হাজার ৩৮০ জন আক্রান্ত হয়েছে পানিবাহিত নানা রোগে। বানের তোড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট, ঘর-বাড়ী ও ছোট বড় সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ বহু স্থাপনা।
বন্যাকবলিত এলাকায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েগেছে কৃষি-ক্ষেত-খামার ও কৃষি ব্যবস্থাপনা। মারা যাচ্ছে বিভিন্ন জাতের গৃহপালিত পশু। বলাযায় বন্যার এ ধ্বংসলীলা অবর্ণনীয়। বিশেষজ্ঞদের ধারনা এ বন্যা ছুঁইতে পারে আগষ্ট। ফলে আতঙ্ক বেড়ো গেল বহুগুনে। জানিনা, এসময়ে কোথায় গিয়ে ঠেকবে বন্যার এ নির্দয় ধ্বংসযজ্ঞ। মহামারী করোনার আক্রমনে দেশের মানুষ যখন অর্ধাহার-অনাহারে বিপর্যস্ত ঠিক তখনই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার অর্ধমৃত মানুষগুলোর উপর হানা দিল সর্বনাশা বন্যা। বলতে গেলে এ যেন ‘মরার উপর খরার ঘা’।
দেশের এ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা চারদিন আগে থেকেই শুরু করেছে তাদের বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম।
২৩০টি নদী বেষ্টিত বাংলাদেশে প্রতি বছরই হয়ে থাকে এমন বন্যা। কখনো ছোট কখনোবা বড়। গত ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ সালে এদেশে হয়ে গেছে প্রলয়ংকারী বন্যা। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ছিল ২০০৪ সালে। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী পেছনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, এদেশে গত ১০৭ বছরের ইতিহাসে ১৯১০, ৩১, ৫৪, ৫৬, ৬২, ৬৬, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০, ৮৪, ৮৭, ৮৮, ৯৮, ২০০০, ২০০৪, ২০০৭ ও ২০১৪, ২০১৭ বর্তমান ২০২০ সালসহ বন্যা হয়েছে ২১ বার। গড়ে বন্যা হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর অন্তর অন্তর একবার । তাছাড়া ছোট খাট বন্যাতো হচ্ছে প্রতি বছরই। বলা যায় বাংলাদেশে বন্যার এটি যেন একটি রুটিন ওয়ার্ক।
বছরঘুরে নিশ্চিৎ এমন বন্যা জেনেও আমরা পারছিনা এর সঠিক কারনগুলো নির্ণয় করতে। খুজে দেখছিনা কি এর প্রতিকার। নিচ্ছিনা টেকসই কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। বিষয়টি রহস্যাবৃতই বলা চলে।
মূলতঃ এসব বন্যার পেছনে যেমনি রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির অপ্রতিবেশীসুলভ আচরন তেমনি রয়েছে আমাদের ভূমিবৈশিষ্ট। পাহাড়, উঁচু সমতল, নিম্ন সমতল এই তিন বৈশিষ্ট্যে গড়া দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রায়ই হতে হয় আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। বছরঘুরে হয়ে যায় অপুরনীয় ক্ষতি।
বন্যাকালীন সে দুর্দশার চিত্র অবর্ণনীয়। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় সামগ্রিক জীবনযাত্রা। গভীর দাগ কেটে যায় আপনজনদের হারানোর হাহাকার । প্রকৃতির এই খেয়ালীপনার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। বন্যার সর্বনাশাটানে ভেসে যায় ঘর-বাড়ি। ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন। বিমানবন্দর, স্থলপথ, রেলপথ ভেসে যায় বন্যার পানিতে। যেখানে গাড়ী চলার কথা সেখানে ভাসে বিশালাকার নৌকা। বিপর্যস্ত হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্য হয় বিঘিœত। বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন । বন্যা পরবর্তী দৃশ্যতো আরো করুণ। মানুষ আক্রান্ত হয় পেটের পীড়া, আমাশা, সর্দি, জ্বর, কাশিসহ নানা প্রকার ব্যাধিতে।
আমরা যদি অনুসন্ধান করি তাহলে দেখতে পাব-
অতিবর্ষণ, নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান, ভৌগলিক অবস্থান, উজান রাষ্ট্রের অতিবর্ষিত নদী প্রবাহ, দেশের নিম্নাঞ্চল ভরাট, হিমালয় পর্বতে তুষার গলন, প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি, গাছপালা নিধন, নদ-নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, ফারাক্কার গেট খুলে দেয়া, প্রকৃতির ওপর মানবীয় হস্তক্ষেপ, নদ-নদীর দু’কুল দখল ও ভরাট, জোয়ার ভাটা এবং বায়ু প্রবাহের গতি বিপরীতমুখী হওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, ভূ-গাঠনিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কারনে প্রতি বছর আমাদের উপর নেমে আসে বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ।
বার্ষিক বন্যার এমন ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে হবে আমাদের। নিতে হবে কার্যকরী ও টেকসই প্রতিকারমূলক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর জন্য আমাদের প্রথমেই করতে হবে।
বন্যা সর্ম্পকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও খাদ্যাভাব মোকাবেলার জন্য মজবুত রাখতে হবে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী। এরপর স্থায়ীভাবে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বহুতল আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, উজান এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে বর্ষায় নদীর উদ্ধৃত্ত পানি নিয়ন্ত্রণ, নদীর পাড় উপচানো পানি প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণ, পুরাতন বেড়িবাঁধগুলো উচু করন, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিত করে দেয়ার ব্যবস্থা, রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত কালভাটের ব্যবস্থা,
ভরাট নদী-নালা সংস্কারের মাধ্যমে পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, বৃহৎ নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ, নদীর পাড়সহ সারাদেশে প্রচুর গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন প্রকল্প হাতে নেয়া, টেকসই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-দীঘি ও হাওর-বাঁওড় খনন/পুনঃখনন করে পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বুদ্ধিভিত্তিক মোকাবেলার মাধ্যমে মরন ফাঁদ ফারাক্কাকে অকার্যকর করে দিতে হবে আমাদের।
প্রতিকারমূলক এসব ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। দেশের মানুষের স্বস্থি, শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে বন্যার এসব স্থায়ী সমাধানের উপর ।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের অসহনশীল মনোভাবের মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। দেশটির সাথে কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠির সম্পর্ক উচ্চতায় তুলতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দেয়া হবে বিশ্বাস ঘাতকতা। ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে চালাতে হবে কুটনৈতিক তৎপরতা। তাহলেই অকার্যকর করে দেয়া যাবে ফারাক্কার মরণ ফাঁদ। সে জন্য চাই জাতীয় উদ্যোগ। চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা সরকারের পাশাপাশি বিরোধীদলগুলোসহ জনগণেরও। জাতীয় সমস্যা মোকাবিলায় জাতীয় উদ্যোগের প্রয়োজনে সকলকে এক টেবিলে বসানোর এ দায়িত্বটা নিতে হবে সরকারকেই। তাহলেই বের হতে পারে সর্বনাশা বন্যার সমস্যা সমাধানে উত্তম কোন পথ। তখন হয়তো বাঁচবে দেশ বাঁচবে জাতি।