মঙ্গলবার , সেপ্টেম্বর ১৭ ২০২৪
দিন যায়, মাস যায়, সন্তানহারা মা-বাবার শোক কাটে না

দিন যায়, মাস যায়, সন্তানহারা মা-বাবার শোক কাটে না।

চাঁদপুর দিগন্ত ডেস্ক

জুলাই হত্যাকাণ্ডে যেসব মা-বাবা তাদের নিরীহ শিশু সন্তানদের হারিয়েছেন তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এ ধরনের পাশবিক বর্বরতা। আল-জাজিরা এ নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে তাদের একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে, ‘কেন আমার সন্তানকে হত্যা করা হলো?’ বাংলাদেশে সংঘর্ষের একমাস পরও বাবা-মায়েরা শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নাই।

শোকাহত পিতামাতারা তাদের সময় স্মৃতির সাথে ভাগ করে নেন এই ভেবে যে বচ্চারা জুলাইয়ের অশান্তি এবং শিক্ষার্থীদের উপর দমন-পীড়নের সময় নিহত হয়েছিল।

চার বছর বয়সী আব্দুল আহাদের খেলনাগুলোর ওপর ধুলোর আস্তরণ জমছে। বাবা মায়ের সাথে রায়েরবাগ পাড়ায় ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় হট্টগোল দেখছিল সে। আব্দুল, উচ্চস্বরে, কৌতূহলী এবং সর্বদা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাই ছিল যার দুষ্টামি কিংবা ব্যস্ততা সে সেদিনও মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল “বাবা, দেখো। দেখো কি হচ্ছে,” আর তখনি ঘাতক বুলেট এসে তার চোখ ভেদ করে। তার মা সুমি আক্তার পাশে থেকে টের পায়নি যে তার সন্তান আর নেই।

প্রথমে আবুল ভেবেছিল তার ছেলে পিছলে পড়ে গেছে কিন্তু পরে তার মুখে, মাথায় ও কাঁধে রক্ত দেখতে পায়। তার ডান চোখে গুলি লেগেছে। সুমি, তার মা চিৎকার করতে থাকে।

“মেঝে রক্তে ঢাকা ছিল। গুলি কোথা থেকে এলো জানি না। সেই মুহূর্তে আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল,” আবুল স্মরণ করে, তার কণ্ঠ বিষাদে দম বন্ধ হয়ে আসে। শুধু এটুকু বিষাদভরা উচ্চারণে আবুল জানান, ‘আমার সন্তান আমার নিজের বাড়িতে নিরাপদ ছিল না’। হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখার পরের দিন সন্ধ্যায় আইসিইউ থেকে একজন চিকিৎসক এসে জানান, আবদুুল মারা গেছেন। আবুলের এসব প্রশ্নের জবাব দেবে কে? একটি নিষ্পাপ শিশুকে কেন মরতে হলো? কিংবা “আমি একজন সরকারি কর্মচারী। আমার দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার সন্তান নির্দোষ ছিল।”

সুমি গ্রামের বাড়িতে ছেলেকে দাফনের পর শহরে ফিরে আসতে পারছে না। কিংবা অন্য ছেলেদের সামনে সুমি গেলে আব্দুলের কথা মনে পড়ে যায়। এখন, আবুল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আব্দুলের খেলনাগুলোর দিকে। ‘আমি আমার ছেলের প্রিয় গাড়িগুলোকে বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখতে পছন্দ করি।’

ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশে জুলাই মাসে বিক্ষোভ চলাকালে অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এই সংখ্যার প্রায় তিনগুণ শিশু নিহত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে হাসিনার পদত্যাগের পরপরই অস্থিরতা এবং অস্থিরতায় ৬০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হতে পারে। নিহত ব্যক্তিরা মূলত ছাত্র বিক্ষোভকারী এবং পথচারী কিন্তু সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও ছিলেন। প্রতিবেদনে বেশির ভাগ হত্যা ও আহতের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী ও ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়েছে।

আল জাজিরা অস্থিরতার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শিশুদের বেশ কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বলেছে। তাদের সন্তানদের কে হত্যা করেছে তা তাদের কেউ জানে না।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় সব শিশুই নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মারা গিয়েছিল, বেশির ভাগই পুলিশ।’

২০ জুলাই বিকেলে মধ্য ঢাকার আবাসিক পাড়া চিটাগাং রোডের মুক্তিনগর এলাকায় বাসার পাশের গলির শেষ প্রান্তে ১০ বছর বয়সী হোসেন মিয়া মাঠে গিয়ে খেলতে চান। ১৫ জুলাই থেকে তার পাড়ায় বিক্ষোভ চলছে। তার মা মালেকা বেগম হোসেনকে বাইরে যেতে না দিলে, সে তার মাকে বলে, “মা, আমি তো একটা বাচ্চা। কে আমাকে গুলি করবে?’ মা হোসেনকে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরতে বলেছিলেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হোসেন চলে যান। কিন্তু ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সে ফেরেনি।

হোসেনের বাবা আচার বিক্রেতা মানিক মিয়া, শঙ্কিত হয়ে ছেলেকে খুঁজতে গিয়েছিলেন- যেয়ে দেখতে পান সর্বত্র কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া, পুলিশ যানবাহন থেকে বের হচ্ছে এবং গুলির শব্দ। ‘সবাই দৌড়াচ্ছিল,’ মানিক বলেন, ‘আমি এখানে এবং সেখানে পুলিশ গুলি চালাতে দেখেছি এবং সর্বত্র টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া ছিল।’ তার ছেলে হোসেন যে মাঠে খেলতে গিয়েছিলেন, সেই মাঠের দিকে যাওয়ার রাস্তায় পৌঁছলে পুলিশ অফিসার এবং বেশ কয়েকটি গাড়ি রাস্তা অবরোধ করে। আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে ভয় পান মানিক।

মাঠে ঢুকতে না পারলেও মানিক অন্য ক্ষেতে, বাজারে, প্রতিবেশীদের কাছে হোসেনের কথা জিজ্ঞেস করতে যান। বাড়ি ফেরার আগেই দুই ঘণ্টা কেটে যায়। তারপর তিনি এবং মালেকা তাদের আট এবং ছয় বছর বয়সী দুই মেয়েকে বাড়িতে রেখে ফের হোসেনকে খুঁজতে যান।

নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে রাস্তায় তখন অন্যরা ছিল। আহত এবং মৃতদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হচ্ছে এবং আশপাশের লোকেরা আপডেট শেয়ার করছে এবং তাদের আশপাশের লোকদের তাদের পরিবারের সদস্যদের শনাক্ত করতে সাহায্য করার চেষ্টা করছে।

এই সময়ে মানিক দম্পতি উন্মাদ ছিল। যখন তারা রাস্তায় লোকজনকে হোসেন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন একজন লোক তাদের কাছে এসে সাহায্য করার চেষ্টা করে। তিনি তাদের ওই এলাকার লোকজনের ছবি দেখান যারা আহত হয়েছে। রক্তাক্ত কোমরে হোসেনকে দেখতে পেয়ে তার মা-বাবা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ওই ব্যক্তি তাদের জানান, আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই মালেকা ও মানিক সেখানে ছুটে যান।

সেখানে অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনকে খুঁজছিল এবং স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বা কিছু ক্ষেত্রে মর্গে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। বেলা ২টার দিকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন তারা কার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং মানিক তাকে হোসেনের কথা বললে লোকটি তাদের মর্গে নিয়ে আসেন। তারা সেখানে অন্য লাশের মধ্যে হোসেনকে পড়ে থাকতে দেখেন।

মানিক বলেন, হোসেনের পিঠে ও নিতম্বে দুবার গুলি করা হয়েছিল। ‘আমি একজন গরিব মানুষ। আমার ছেলের হত্যার বিচার কে দেবে?’

মালেকা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “সে আমার একমাত্র ছেলে ছিল।

‘কেন আমার সন্তানকে হত্যা করা হলো?

ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপের সীমাহীন শক্তি এবং একটি সংক্রামক হাসি ছিল। সে ঘর থেকে অন্য ঘরে ছুটবে, পা থুবড়ে পড়বে এবং সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠবে অন্য বাচ্চাদের সাথে পুতুল নিয়ে খেলতে। তার প্রফুল্লতা তার প্রতিবেশীদের মধ্যে পরিচিত ছিল, যারা তাকে আদর করতেন।

তার বাবা দীপক কুমার গোপ তার একমাত্র সন্তান সম্বন্ধে বলেন, ‘আমার মেয়েকে দেখতে পুতুলের মতো লাগছিল, যার মুখ গোলাকার, চওড়া চোখ এবং পনিটেল ছিল।

১৯ জুলাই বিকেলে, রাস্তায় সংঘর্ষ শুরু হলে দীপক রিয়াকে নিয়ে ছাদে ছুটে যায়। বাচ্চাটি কোলে ছিল এবং বাবার কাঁধে সে পড়ে গেল। একটি গুলি তার মাথার পেছনে এসে লাগে। হাসপাতালে রিয়ার মাথা থেকে বুলেটটি অস্ত্রোপচার করার চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। সে অজ্ঞান ছিল এবং তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল, পুরো সময় তার বাবা-মা তার পাশে ছিল।

পাঁচ দিন পর রিয়া মারা যায়। দীপক যখন আলজাজিরাকে বলেন, বিয়ের অনেক বছর পর আমার সন্তানের জন্ম হয়েছে। তার আগমনের জন্য আমাদের এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল,’ তখন কথা বলার সময় চোখের জল আটকে রেখেছিলেন।

‘আমাকে বিচার দেবে কে? আমার সন্তানকে যখন ইতিমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে তখন কথা বলে লাভ কী? আমার সন্তানকে কেন হত্যা করা হলো? দীপক জিজ্ঞেস করে, তার গলা কাঁপছে।

একই দিন ১১ বছর বয়সী সাফকাত সামির মিরপুর কাফরুলে সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক আবাসিক এলাকায় তার পরিবারের বাড়ির জানালার পাশে তার পড়ার টেবিলে বসেছিলেন। বাইরে, রাস্তায় চলমান বিক্ষোভে ভরা ছিল, যা পুরো আশপাশের এলাকাকে গ্রাস করেছিল। বিকেলের আগে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হিসেবে যা শুরু হয়েছিল তা ছাত্র বিক্ষোভকারীদের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত বাড়তে থাকে টিয়ারগ্যাস বাতাসে ভরে যায় এবং গুলির শব্দ রাস্তায় ভেসে যায়।

সন্ধ্যায় বাড়িতে কাঁদানে গ্যাস ঢুকতে শুরু করলে সাফকাতের মামা মশিউর রহমান দ্বিতীয় তলার জানালা বন্ধ করতে যান। একটি গুলি মশিউরের কাঁধে চেপে গিয়ে পেছনে দাঁড়ানো সাফকাতের ডান চোখ ভেদ করে।

সাফকাতের শোকার্ত বাবা সাকিবুর রহমান বলেন, ‘আমার স্ত্রী কারো সাথে কথা বলে না, আমার ছেলে নির্দোষ ছিল। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তার কি দোষ ছিল?’

সাকিবুর অনিশ্চিত যে সরকার ন্যায়বিচার করবে কি না, এমন কিছু তিনি বলেছেন যা তিনি অনুসরণ করার সামর্থ্য রাখেন না। ‘আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আদালতের মামলায় যাওয়ার সামর্থ্য নেই। পৃথিবীতে কোনো বাবাই এ শোক সইতে পারে না।

যেমন শিশু আব্দুলের বাবা আবুলের ইচ্ছা হচ্ছে, ‘আমি চাই না আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য নির্দোষ কেউ শাস্তি পাক, আমি সঠিক তদন্ত চাই। আমার পৃথিবী ভেঙ্গে গেছে,’ আবুল বলে, তার কণ্ঠ কাঁপতে থাকে, চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। ‘কেউ কিভাবে এই ক্ষতি পূরণ করতে পারে?’- আল-জাজিরা