বৃহস্পতিবার , সেপ্টেম্বর ১৯ ২০২৪

টানাবর্ষণে চাঁদপুরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : তীব্র জলাবদ্ধতায়  জনদুর্ভোগ চরমে

ইলিয়াছ পাটওয়ারী

লঘুচাপ সুস্পষ্ট হওয়ায় ভারীবর্ষণ তীব্র হয়েছে। গত কয়েক দিনের টানা ও প্রবল বৃষ্টিপাতের সাথে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে মেঘনার চর ও হাইমচরের নিম্নাঞ্চল, রাস্তা, অলিগলি, বীজতলা তলিয়ে গেছে। ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জে তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

এতে মানুষের চরম ভোগান্তি শুরু হয়েছে। মানুষের বসতঘর ও রান্নাঘর তলিয়ে যাওয়ায় রান্না করতে না পেরে অনেককে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে।

পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৭১ মিলিমিটার। এখন পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।

চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের ভেতরে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তীব্র জলাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ বাড়ির রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ভাবে তলিয়ে গেছে। অনেকের পুকুরে চাষকৃত মাছ ভেসে যায়।

ফরিদগঞ্জ ব্যুরো জানান, ফরিদগঞ্জ উপজলার অধিকাংশ গ্রামে পানি জমে জলবদ্ধতা হয়ে মানুষের জনদূর্ভোগ চরমে। উপজেলার ৫নং ও ৬নং গুপ্টি, ৩নং ও ৪নং সুবিদপুর এলাকায় পানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এদিকে ফরিদগঞ্জ উপজেলার বেড়ীবাঁধ এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুযোগ না থাকায় মানুষের ঘর বাড়িতে পর্যন্ত পানি প্রবেশ করে।

অনেকের রান্নাঘরে পানি প্রবেশ করায় রান্নাবান্না পর্যন্ত করতে পারছেনা।

বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। বিকল্প পদ্ধতিতে মানুষ রান্নাবান্না করতে গিয়ে পড়েছে বিপাকে। গত কয়েকদিনে এখানকার মানুষ ঘরবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। কড়ৈতলী গ্রাম সাচনমেঘ  আলগাজ্জালী মাদ্রাসার বন্যা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক।

ফরিদগঞ্জ নারিকেলতলা গ্রামের রাশেদ বেপারী ও আব্দুল ছাত্তার পাটোয়ারী বলেন, আমাদের বেড়ীর ভিতরে সব রাস্তা ঘাট, ঘর বাড়ী পানিতে ডুবে গেছে। বাড়ীতে গৃহিণীদের রান্না ঘর পানিতে ডুবে যাওয়ার ফলে রান্নাবান্না করতে গিয়ে হিমসিমে পড়তে হয়। বিকল্প জ্বালানি হিসাবে গ্যাসের বোতল ও তলা চুলা ব্যবহার হচ্ছে।

হাজীগঞ্জ ব্যুরো জানায়, টানা বৃষ্টিতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রায় সবগুলো গ্রামে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষকরে দক্ষিণ অঞ্চলের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘর থেকে বের হতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষজন।

হাজীগঞ্জ পালিশারা এলাকার জসিম কাজী ও ওসমান গণি বলেন, খুব সকালে বৃষ্টির কারণে কোনোমতে বাজারে আসলেও টানা বৃষ্টির কারণে দোকান খোলা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হলেও আজকে এক টাকাও আয় হয়নি। খালি হাতে ফিরতে হবে বাড়ি।

হাজীগঞ্জ বিশ্বরোডের চা দোকানী গনেশ দ্যা বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে দোকান খোলা সম্ভব হয়নি। তবে দোকান খুললেও কাষ্টমার পাওয়া যায়নি, কারণ বিশ্বরোড চত্বরেই যত পানি, এতে মানুষ কিভাবে আসবে।

হাজীগঞ্জ বাজারের রিকশাচালক ওহিদুল ইসলাম বলেন,

একদিন রিক্সা নিয়ে বের হতে না পারলে ধারদেনা বেড়ে যায়। গত রবিবার থেকে টানা বৃষ্টির কারণে বাইরে মানুষের চলাফেরা কমে গেছে। রিকশা বন্ধ করে ঘরে বসে দিন পার করছি।

এই বয়সে ভিজলে অসুস্থ্য হতে হবে নির্ঘাত। আগের মতো শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নাই। গতকাল থেকে রিক্সা বের করতে না পারায় সমস্যা তৈরী হয়েছে। রাতের খাবার নিয়ে চিন্তায় আছি।

ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী দুলাল হোসেন বলেন, ভারি বর্ষণের ফলে কাপড়ের দোকান খোলা সম্ভব হয়নি। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় আছি, বৃষ্টি কমলে দোকান খুলবো। কিন্তু বৃষ্টি কমার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি। বাড়িতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের সময় দেই।

অন্যদিকে টানা বৃষ্টির কারণে হাজীগঞ্জ বাজারে অটোরিক্সার সংখ্যা অনেক কম। ফলে অটোরিক্সা চালকরা ভাড়া চাচ্ছেন ইচ্ছেমতো। বাড়তি অর্থ গুণতে গিয়ে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন বাক-বিতণ্ডায়। বাড়তি ভাড়া দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, বাড়ি থেকে কলেজে আসার পথে রিক্সা ভাড়া ৩০ টাকা, অটো ভাড়া ১০ টাকা। অথচ আজকে বৃষ্টির কারণে রিক্সা ভাড়া ৫০ টাকা চাচ্ছে, অটো ভাড়া ২০ টাকা চাচ্ছে।

বাধ্য হয়েই সকালে বেশি ভাড়া দিয়ে কলেজে আসতে হয়েছে। এখন বেশি ভাড়া দিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন অভিযোগ করলেন আরো কয়েকজন।

এদিকে কেউ কেউ বলছে টানা বৃষ্টিপাতের রেকর্ডে হয়তো পুরাপুরি বন্যা হয়ে যাবে।

অন্যান্য সময়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা বা জনপ্রতিনিধিরা খোঁজ নিলেও এবার দেশের এ পরিস্থিতিতে কারো দেখা মেলেনি। টানা এ বৃষ্টিতে অর্থশালী ও প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছেন ঘরবন্দী সাধারণ মানুষ।

হাইমচর প্রতিনিধি জানায়, উপজেলার বেড়ির বাহিরে লামচরি, তেলির মোড়, চর ভৈরবী, হাইমচর, নীলকমল এলাকায় পানিবন্দী হয়ে আছে সাধারণ মানুষ।

মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাতের কারণে তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পানির ট্যাংকি মতলব দক্ষিণ। কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত।

গতকাল বুধবার (২১ আগস্ট) দুপুরে বৃষ্টিপাতের এই তথ্য জানান চাঁদপুর আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহ মো. শোয়েব।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) রাত ১২টা থেকে গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত আছে।

টানা বৃষ্টির কারণে গতকল সকাল থেকে শিশু শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় যেতে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও খেটে খাওয়া মানুষ সড়কে নেমেছে। বিশেষ করে রিক্সা চালক ও হকারদের সড়কে দেখা গেছে।

এদিকে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের ভেতরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

যার ফলে সড়ক, মাছের ঘের ও বসবাড়িতে পানি উঠেছে। পানি বন্ধি হয়ে পড়েছে বহু পরিবার।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আল-আমিন জানান, গত ক’দিনের টানা বৃষ্টিতে সড়ক ও বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। বেড়ি বাঁধের পানি না কমায় মাছের ঘেরগুলো নিয়ে খামারিরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছে।

পানিবন্দী লোকজনও পরিবারের শিশু এবং বয়স্কদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি।

জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা ছিলো ৩.৭ মিলিমিটার এবং ভাটার সময় ছিলো ৩.৬ মিলিমিটার। ক্যাপশন:  টানাবর্ষণে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার চিত্র।